ঘূর্ণিঝড় প্রস্ততি কর্মসূচির ইতিহাস
অবতরণিকা
আবহমান কাল থেকেই বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী দেশসমূহে উষ্ণমন্ডলীয় ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনে চলেছে। মোঘল আমলে আবুল ফজল রচিত আইন-ই-আকবরীতে ১৫৮৪ সালে একটি ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় বরিশাল জেলার উপকূলবর্তী এলাকায় আঘাত হানার কথা উল্লেখ আছে। ১৮৭৬ সালে যে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়টি বরিশাল, নোয়াখালী ও চট্টগ্রাম জেলার উপর দিয়ে বয়ে গিয়েছিল তাতে প্রায় দুই লক্ষ লোকের প্রাণহানি হয়েছিল। বাংলাদেশে সংঘটিত অসংখ্য ঘূর্ণিঝড়ের ধারাবাহিকতায় ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বরে একটি প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ২০ থেকে ৩৫ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাস সহকারে পটুয়াখালী, ভোলা ও নোয়াখালী জেলার বিস্তীর্র্ণ এলাকার উপর আছড়ে পড়েছিল। এই ঝড়ে ১০ লক্ষ মানুষের প্রাণহানি ঘটে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড় এবং নির্বাচন
যখন ঘূর্ণিঝড়টি আঘাত হানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছিলেন। ঘূর্ণিঝড়ের পরপরই তিনি নির্বাচনী কার্যক্রম বন্ধ রেখে প্রায় দুই সপ্তাহ ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেন ও জনগণের পাশে দাঁড়ান। সে সময় তিনি ঘূর্ণিঝড় থেকে মানুষকে রক্ষায় পাকিস্তানী সরকারের অবজ্ঞা ও অবহেলার অসংখ্য প্রমাণ পান। ২৭ নভেম্বর ঢাকায় ফিরে পুরো বিষয়টি তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে তুলে ধরেন। এতে প্রতিভাত হয় যে, প্রতিটি বাঙালি তখন একটি সত্যিকারের জীবন সংকটের মধ্যে ছিল। ঐ ঘূর্ণিঝড়ে ১০ লক্ষ মানুষের মৃত্যু, আরও তিন লক্ষ মানুষের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে বেঁচে থাকার লড়াইয়ের চিত্র তুলে ধরে তিনি পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে এক মিলিয়ন বাঙালী হত্যার অভিযোগ আনেন। তাঁর সেই বিবৃতি ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত ও অবহেলিত জাতির মানসিকতাকে আরো সুদৃঢ় করে এবং নির্বাচনে পূর্ব বাংলার মানুষের সিদ্ধান্তকে গুরুতরভাবে প্রভাবিত করে।
এটি প্রমাণিত যে, ১৯৭০ এর সাইক্লোনে এতো অধিক সংখ্যক প্রাণহানির অন্যতম কারণগুলো ছিল- স্বৈরাচারী পাকিস্তান সরকার কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানে উপকূলীয় ঝুঁকিহ্রাস কার্যক্রমকে অগ্রাধিকার তালিকায় না রাখা, আগাম সতর্ক সংকেত প্রচারের ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা এবং ঘূর্ণিঝড় সতর্ক সংকেত বিষয়ে জনগণকে সচেতন করার বিষয়ে অবহেলা।
মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সে সময়কার প্রকৃত চিত্র সোচ্চারভাবে তুলে ধরার পাশাপাশি ভোলা ও নোয়াখালীর বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থান করে দুর্গত মানুষের সেবায় আত্মনিয়োগ, সাধ্যানুসারে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ ও সান্ত্বনা প্রদান করেন। তিনি দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস ব্যবস্থাপনাকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের গুরুত্ব সম্যকভাবে উপলব্ধি করেন।
বঙ্গবন্ধুর তৎপরতার কারণে ‘সাইক্লোন ১৯৭০’ এর সংবাদ শুনে বিশ্বের মানুষ হতবাক হয়ে যায়। একটি ঘূর্ণিঝড়ে এতো অধিক সংখ্যক মানুষের প্রাণহানির খবর মানুষের অন্তরকে নাড়িয়ে দেয়। বিশ্ব বিবেক ক্ষণিকের জন্য হলেও স্তম্ভিত হয়ে পড়ে। এই মর্মান্তিক ঘটনার পর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ একটি বিশেষ অধিবেশন আহবান করে এবং সর্বসম্মতিক্রমে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের উপকূলীয় এলাকায় ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষয়ক্ষতি কমানোর কার্যকরি ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য লীগ অব রেড ক্রস এন্ড রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিকে দায়িত্ব অর্পণ করে।
ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি বিষয়ে কার্যক্রম গ্রহণ
‘ভোলা সাইক্লোনের’ পর ত্রাণ ও পুনর্বাসন কাজে সহায়তার জন্য লীগ অব রেড ক্রস এন্ড রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির বেশ কয়েকজন ডেলিগেট তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে আসেন। এদের মধ্যে সুইডেনের একজন নাগরিক মিঃ ক্ল্যাস হেগষ্ট্রম রিলিফ ডেলিগেট হিসাবে ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকায় আসেন এবং ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি বিষয়ক কার্যক্রম শুরু করেন।
মিঃ হেগষ্ট্রম পটুয়াখালী, বরিশাল ও ভোলা জেলার ঘূর্ণিঝড় বিধ্বস্ত এলাকায় সর্বস্তরের মানুষের সাথে নিবিড়ভাবে আলাপ আলোচনা ও মত বিনিময় করেন। দীর্ঘ দুই মাসের অধিক সময়কাল উপকূলীয় অঞ্চল পরিদর্শনের পর মিঃ হেগষ্ট্রম ‘ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির’ রূপরেখা প্রণয়ন করেন।
প্রাথমিক কাঠামো
তদানীন্তন বৃহত্তর চট্টগ্রাম জেলা, নোয়াখালী জেলা, বাকেরগঞ্জ (বরিশাল) জেলা ও পটুয়াখালী জেলার মেটি ২৩ টি থানায় (টেকনাফ, কক্সবাজার, মহেশখালী, চকোরিয়া, কুতুবদিয়া, সন্দীপ, সীতাকুন্ড, মিরসরাই, সোনাগাজী, কোম্পানীগঞ্জ, সুধারাম, হাতিয়া, রামগতি, মনপুরা, দৌলতখান, লালমোহন, তজুমদ্দিন, চরফ্যাশন, গলাচিপা, কলাপাড়া, আমতলী, বরগুনা ও পাথরঘাটা) ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কার্যক্রম শুরু হয়।
১,৯৭২ সালের আগস্ট মাসের মধ্যে ২৩ টি থানার ১৮৬ টি ইউনিয়নের আওতাধীন ১,৯২৭ টি ইউনিটের মোট ১৯,২৭০ জন স্বেচ্ছাসেবক নির্বাচন কাজ সম্পন্ন হয়।
ঘূর্ণিঝড়ের আগাম সতর্ক সংকেত প্রচারে নির্ভরযোগ্য ও তড়িৎ যোগাযোগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে উপকূলীয় সবকটি থানার সাথে ঢাকা ও আঞ্চলিক দপ্তরগুলোর বেতার যোগাযোগ স্থাপিত হয়। একই সাথে দূরবর্তী ইউনিয়ন ও বিচ্ছিন্ন দ্বীপসমূহের সাথে থানা পর্যায়ের বেতার যোগাযোগ স্থাপিত হয়। শতাধিক ওয়্যারলেস সেটসহ বিপুল পরিমান সাংকেতিক যন্ত্রাদি সর্বদা সচল রাখার জন্য ঢাকায় একটি রেডিও ওয়ার্কসপ এবং চট্টগ্রাম ও বরিশালে দুইটি সাংকেতিক যন্ত্রাদি মেরামত ওয়ার্কসপ স্থাপন করা হয়।
মুজিব কিল্লা নির্মাণ
১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিনে হাতিয়ার মৌলভীর চরে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রথম কিল্লা নির্মাণের কাজ শুরু হয় এবং একমাস পর কিল্লা নির্মাণ সমাপ্ত হয়। ২০ এপ্রিল কিল্লাটির শুভ উদ্বোধন করা হয় এবং ‘মুজিব কিল্লা’ নামকরণ করা হয়। উল্লেখ্য যে, মুজিব কিল্লার প্রয়োজনীয়তা ও কার্যকারিতার পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু উপকূলব্যাপী দুই শতাধিক কিল্লা নির্মাণের জন্য অর্থ বরাদ্দ দেন। ঐ বরাদ্দের ভিত্তিতে ১৯৭৩-৭৪ সালে সিপিপি উপকূলের বিভিন্ন এলাকায় ১৩৭ টি মুজিব কিল্লা নির্মাণ কাজ সমাপ্ত করে।
বঙ্গবন্ধুর হাতে সিপিপির দীর্ঘস্থায়িত্বের ব্যবস্থা
লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন ও সম্পদ রক্ষার্থে নিয়োজিত সিপিপির মতো একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সংগঠনের দীর্ঘ স্থায়িত্বের বিষয়টি যখন বঙ্গবন্ধুর কাছে উপস্থাপন করা হলো, তখনই তিনি উপলব্ধি করলেন যে, উপকূলবর্তী অঞ্চলে বসবাসকারী কোটি মানুষের জীবন ও সম্পদ রক্ষার্থে যে সংগঠন কাজ করছে, সে প্রতিষ্ঠানের বিদেশী কোন সংস্থার অনিশ্চিত আর্থিক সহযোগিতার উপর নির্ভরশীল থাকা উচিৎ নয়। ১৯৭৩ সালের ২৮ জুলাই তারিখে বঙ্গবন্ধু এই মর্মে একটি যুগান্তকারী অনুমোদন দিলেন যে, সাইক্লোন প্রিপেয়ার্ডনেস প্রোগ্রামের যাবতীয় খরচ বাংলাদেশ সরকার বহন করবে এবং এই সংগঠনটি বাংলাদেশ সরকার ও বাংলাদেশ রেড ক্রস সোসাইটির যৌথ ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হবে। কর্মসূচি পরিচালনার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুমোদনক্রমে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর নেতৃত্বে পলিসি কমিটি এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিবের নেতৃত্বে ইমপ্লিমেন্টেশন বোর্ড গঠিত হয়।
উল্লেখ্য যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুমোদনক্রমে গঠিত উক্ত পলিসি কমিটি ও বাস্তবায়ন বোর্ড এবং এর ধারা ও উপধারাসমূহ পরবর্তীতে ধারাবাহিকভাবে দুর্যোগ বিষয়ক স্থায়ী আদেশাবলিতে সন্নিবেশিত হয়।
বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বেচ্ছাসেবকদের উদ্দীপ্তকরণ
১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ওয়ারলেসের মাধ্যমে সিপিপির স্বেচ্ছাসেবকদের সাথে কথা বলেন। তাদের মানবসেবায় উদ্দীপ্ত করেন, স্বেচ্ছাসেবার মূলমন্ত্র তাদের হৃদয়ে গেঁথে দেন। বেইলি রোডে অবস্থিত প্রধানমন্ত্রীর অস্থায়ী কার্যালয়ে (রমনা পার্কের পূর্বদিকের গেইটটির সম্মুখে) সিপিপির সিঙ্গেল সাইড ব্যান্ড ওয়্যারলেস সেট স্থাপন করা হলো। অপর দিকে মাঠ পর্যায়ে সিপিপির সকল অফিসে ওয়্যারলেসের সাথে বড় বড় লাউড স্পিকার সংযোগ দেওয়া হয়। অফিসের সামনে উপস্থিত ছিল হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবক। বঙ্গবন্ধু প্রায় ১০/১২ মিনিট স্বত:স্ফূর্তভাবে বক্তব্য দেন। স্বেচ্ছাসেবকগণ এবং উপস্থিত লোকজন মন্ত্রমুগ্ধভাবে মহান নেতার অমীয় বাণী সরাসরি শোনেন। আজও অনেক প্রবীণ স্বেচ্ছাসেবকের কাছে বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণের স্মৃতিচারণ শোনা যায়। সিপিপি স্বেচ্ছাসেবকদের কোন আর্থিক প্রতিদান ছাড়া বিনাস্বার্থে মানবসেবার ধারা দেখে মনে করা হয় যে, বঙ্গবন্ধুর সেই অনুপ্রেরণাই প্রজন্মান্তরে সিপিপির স্বেচ্ছাসেবকেরা আজও হৃদয়ে ধারণ করে চলেছে।